আগামী অর্থবছরের জন্য বড় অঙ্কের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেওয়া হয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর)। অথচ রাজস্ব আদায়ে গতিশীলতা আসবে- এমন উদ্যোগ নেই রাজস্ব-সংক্রান্ত প্রস্তাবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সার্বিক বিচারে আসছে অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ে এনবিআরের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে না। ঘাটতি রাজস্বের ফলে সরকারের ঋণ বাড়বে, উন্নয়ন কার্যক্রম অসমাপ্ত রাখতে বাধ্য হবে। পদ্মা সেতু নির্মাণে থাকবে স্থবিরতা। সরকারের আয়-ব্যয়ে ভারসাম্য নষ্ট হবে। এতে সামষ্টিক অর্থনীতি ঝুঁকিতে পড়বে।
আগামী অর্থবছরের জন্য এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা এক লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে এনবিআর অর্থ মন্ত্রণালয়কে লিখিতভাবে জানিয়েছে, চলতি অর্থবছরের শেষ সময় পর্যন্ত এনবিআরে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি থাকার সম্ভবনা রয়েছে। তাই আগামী অর্থবছরে রাজনৈতিক অস্থিরতা বিবেচনায় রেখে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা কমানো দরকার। এ ক্ষেত্রে রাজস্ব এক লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা আদায় সম্ভব হবে। এনবিআরের মত অনুযায়ী রাজস্ব লক্ষ্য নির্ধারিত না হলে ঘাটতি দাঁড়াতে পারে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা।
চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা এক লাখ ১২ হাজার ২৫৯ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে (প্রথম ১০ মাসে) ঘাটতি রয়েছে চার হাজার ৯৬৪ কোটি টাকা। এমন পরিস্থিতিতেও এনবিআরের প্রস্তাবে ভিন্ন মত জানিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় নিজস্ব সিদ্ধান্তে অনড় থাকে। চলতি অর্থবছরের তুলনায় আসছে বাজেটে লক্ষ্যমাত্রা ২৩ হাজার ৭৪১ কোটি টাকা বেশি ধরা হয়েছে। যার অর্থ আগামীতে রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধি ২৩.১৪ শতাংশ।
নির্বাচনের আগের বাজেট হওয়ায় ভোটার তুষ্টিই সরকারের লক্ষ্য। আগামী অর্থবছরে পদ্মা সেতুতে অর্থায়নের ভার চাপিয়ে বড় অঙ্কের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা প্রস্তাব হলেও আরোপ হচ্ছে না নতুন কর। মূসক ও শুল্ক-সংক্রান্ত অধিকাংশ রাজস্ব নীতিতেও থাকছে চলতি বারের ধারা।
আগামী অর্থবছরে করমুক্ত আয়সীমা ২০ হাজার টাকা বাড়িয়ে দুই লাখ ২০ হাজার টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব করা হচ্ছে। মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে শুল্ক ৩ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২ শতাংশ করা হয়েছে। অপ্রদর্শিত অর্থ ও কালো টাকা ১০ শতাংশ জরিমানাসহ সাদা করার সুযোগ থাকছে আগামীতেও। অপ্রয়োজনীয় ও বিলাস পণ্যের আমদানি নিরুৎসাহিত করতে আগামী বাজেটেও শুল্ক স্তর চলতিবারের ধারাবাহিকতায় রয়েছে। এর সঙ্গে ৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্কসহ আমদানি পর্যায়ের অন্যান্য শুল্ক অপরিবর্তিত থাকছে। থাকছে ১৮টি শিল্প খাতে কর অবকাশ সুবিধা। আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবে নতুন তিন লাখ কর দাতাকে যুক্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অথচ এনবিআরের দুর্বল প্রসাশনিক কাঠামো শক্তিশালীকরণে কোনো সুনির্দৃষ্ট প্রস্তাব নেই ।
আসন্ন বাজেটে আয়কর আদায়ে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৪৮ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে এ হিসাব ৩৫ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। আয়কর আদায়ে প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৩৭ শতাংশ।
আগামী অর্থবছরের জন্য আয়কর, মূসক ও শুল্ক আদায়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মূসক আদায়ে হিসাব কষা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ২৬.২৪ শতাংশ। ৫১ হাজার কোটি টাকার মূসক আদায়ে প্রস্তাব রয়েছে আসন্ন বাজেটে। চলতি অর্থবছরে মূসক খাতে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ৪০ হাজার ৪৪৬ কোটি টাকা।
নতুন বাজেটে ৩৬ হাজার ৭০০ কোটি টাকার শুল্ক আদায়ে প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে তা ছিল ৩৬ হাজার ৪৯৩ কোটি টাকা।
আসন্ন বাজেটে রাজস্ব আদায়ের সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণের অর্থ সংগ্রহের দায় থাকায় এনবিআরের রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্যমাত্রা অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি ধরা হয়েছে। অথচ নতুন করারোপ করা হয়নি। করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানোয় রিটার্নধারীর সংখ্যা কমার আশঙ্কা রয়েছে। আবার নির্বাচন সামনে থাকায় রাজনৈতিক সহিংসতা কমার সম্ভাবনা নেই বরং বাড়ার আশঙ্কা থাকছে। এতে আমদানি কমবে, ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা নামতে পারে। কলকারখানায় স্বাভাবিক উৎপাদন ব্যাহত হবে। সার্বিক পরিস্থিতি বিচারে রাজস্ব আদায় কমবে। তাই এনবিআরের ওপর এত বড় অঙ্কের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য চাপিয়ে দেওয়ায় অর্থনীতি ঝুঁকিতে পড়বে।
আব্দুল মজিদ বলেন, রাজস্ব ব্যয় কমানো সম্ভব হবে না। তাই ঘাটতি রাজস্বে উন্নয়ন ব্যয় কমাতে বাধ্য হবে সরকার। এতে উন্নয়নমূলক কার্যক্রমে থাকবে স্থবিরতা। এমন পরিস্থিতিতে পদ্মা সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা ব্যহত হবে। আগামী অর্থবছরের রাজস্ব আদায়ে বড় অঙ্কের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করায় অর্থনীতিতে আয়-ব্যয়ের হিসাবে ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের মহাপরিচালক অর্থনীতিবিদ মোস্তফা কে মুজেরী কালের কণ্ঠকে বলেন, চলতি বছরের তুলনায় ২৩ শতাংশ বেশি রাজস্ব আদায়ের সিদ্ধান্ত বাস্তবতা বিবর্জিত, উচ্চ বিলাসী পরিকল্পনা। চলতি বারের ধারাবাহিকতায় আগামীতেও রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। এতে সরকার আরো বেশি ঋণ-নির্ভর হয়ে পড়বে। বৈদেশিক ঋণ পাওয়ার সম্ভাবনা কম থাকায় অভ্যন্তরীণ ব্যাংক ঋণ গ্রহণে বাধ্য হবে সরকার। এতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ কমে যাবে। ফলে বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এভাবে সরকারের উচ্চ রাজস্ব আদায়ের পরিকল্পনায় সামষ্টিক অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে।
Comments[ 0 ]
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন