লালমনিরহাটের হাতীবান্ধার হতদরিদ্র রোকেয়া বেগম। ‘সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি’র আওতায় বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তা পান তিনি। তবে এই অনুদান গ্রহণের জন্য কোনো মধ্যস্থতাকারীর কাছে আর ধর্ণা দিতে হয় না তাকে।
কারণ, তার রয়েছে বাংলাদেশ ডাক বিভাগের পোস্টাল ক্যাশ কার্ড। প্রতিমাসে এই কার্ডে জমা হচ্ছে, অনুদানের অর্থ। আর রোকেয়া কাছের পোস্ট অফিসের পয়েন্ট ওভার সেল (পস) মেশিন থেকে সহজেই অর্থ তুলে নিতে পারছেন।
এভাবেই যেন ব্যাংকিং সেবার বাইরে থাকা হতদরিদ্র মানুষগুলোর ব্যাংক হয়ে উঠছে- বাংলাদেশ ডাক বিভাগ। যেসব মানুষ ব্যাংকের সাজসজ্জায় কাচঘেরা ঘরে ঢুকতে সাহস পেতেন না, তারাও আজ লেনদেন করছেন ডাক বিভাগের পোস্টাল ক্যাশ কার্ডের মাধ্যমে।
এমনই আরেকজন রজিম আলী। দিনমজুরের কাজ করেন বিক্রমপুরে। নীলফামারী বাড়ি হলেও থাকেন বিক্রমপুরে। একসময় পরিবারের কাছে টাকা পাঠানোর জন্য কতই না দুঃশ্চিন্তা ছিল তার। কারণ, সময়মতো টাকা পাঠাতে না পারলে পরিবারের প্রিয় মানুষগুলোকে যে কষ্টে দিন পার করতে হবে! সেই রমিজেরও আছে ক্যাশ কার্ড।
নিজের আয়ের টাকা জমান তার ক্যাশ কার্ডে। গ্রামে স্ত্রীকে করিয়ে দিয়েছেন একটি ক্যাশ কার্ড। তাই, মাস শেষে নিজের ক্যাশ কার্ড থেকে টাকা পাঠিয়ে দেন স্ত্রীর কার্ডে। আর স্ত্রী সহজেই টাকা তুলে নেন। ‘দ্রুত, নিরাপদ ও সাশ্রয়ী আর্থিক লেনদেন’ এই স্লোগান নিয়ে বাংলাদেশ ডাক বিভাগের নতুন এ সেবা পোস্টাল ক্যাশ কার্ড।
ব্যাংকের এটিএম কার্ডের মতোই এটি ব্যবহার করে দেশের যে কোনো প্রান্ত থেকে টাকা উত্তোলন করা যায়। আর ৫২ হাজার প্রান্তিক মানুষের ব্যাংক হচ্ছে- ডাক বিভাগ; যেন ডাক বিভাগ ‘ব্যাংক ফর আন-ব্যাংকড পিপলস’।
গত প্রায় দুই বছরে সারাদেশের বিভাগ, জেলা ও উপজেলার এক হাজার তিনশ ৩২ ডাকঘরে সেবাটি সম্প্রসারিত হয়েছে। আগামী তিন বছরে পৌঁছে যাবে দেশের সবগুলো ডাকঘরে। তাছাড়া, শিগগিরই এই ক্যাশ কার্ড দিয়ে বেতন, ভাতা পরিশোধ করা যাবে। দেওয়া যাবে গ্যাস, পানি ও বিদ্যুতের বিলও। তবে শুধু ডাকঘরে সীমাবন্ধ থাকবে না সেবা। ব্যাংকের মতোই বুথ স্থাপন করা হবে। ঢাকায় এরই মধ্যে পাঁচটি বুথ করা হয়েছে। এ বছরই তার সংখ্যা হবে ২৪। আর তিন বছরের মধ্যে আরো এক হাজার দুইশ বুথ করার ব্যাপক পরিকল্পনা রয়েছে ডাক বিভাগের।
আনুষ্ঠানিকভাবে চালুর প্রথম বছরই সেবাটি দিয়ে ১৭ লাখ টাকা মুনাফা করেছে ডাক বিভাগ। শুধু বিশ্বব্যাংকের অনুদান পরিশোধ করেই আয় করেছে প্রায় ২৫ লাখ টাকা।
সারাদেশে প্রায় ১৪ হাজারের বেশি অনুদানগ্রহীতা এই কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন করছেন। মাত্র ৪৫ টাকা খরচ করে নির্দিষ্ট আবেদনপত্র পূরণ করে ডাকঘর থেকে পোস্টাল ক্যাশ কার্ড কিনতে পারবেন যে কেউই। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকের এটিএম কার্ডের মতো মাসিক বা বার্ষিক কোনো চার্জ কর্তন করা হয় না।
ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অংশ হিসেবে ২০১০ সালের ২৬ মার্চ প্রধানমন্ত্রী পোস্টাল ক্যাশ কার্ডের উদ্বোধন করেন। তবে সব প্রস্তুতি শেষ করে ২০১১ সালের জুলাই মাসে এটি বাজারে নিয়ে আসে ডাক বিভাগ। জানা যায়, এ পর্যন্ত এ সেবার মাধ্যমে ১৮ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে।
বাংলাদেশ ডাক বিভাগের ডেপুটি পোস্টমাস্টার জেনারেল মো. জাকির হাসান নূর বলেন, “ধীরে হলেও ক্যাশ কার্ডের গ্রাহকের সংখ্যা বাড়ছে। বর্তমানে ডাকঘরের নির্দিষ্ট কাউন্টারে গিয়ে পয়েন্ট অব সেলস বা পিওএস মেশিনে ক্যাশ কার্ডটি ব্যবহার করতে হয়।
তবে সোনালী ব্যাংকের সব এটিএম বুথে পোস্টাল ক্যাশ কার্ড ব্যবহারের জন্য ডাক বিভাগ ব্যাংকটির সঙ্গে চুক্তি করেছে। ফলে, ব্যাংকটির যে কোনো এটিএম বুথে ক্যাশ কার্ড ব্যবহার করে সেবা নিতে পারবেন গ্রাহকেরা। এ ছাড়া কিউ ক্যাশের অন্যান্য এটিএম বুথেও কার্ডটি একইভাবে ব্যবহার করা যাবে শিগগিরই।”
তিনি আরো বলেন, “শিগগিরই আমরা মোবাইল নম্বর ব্যবহার করে একটি কার্ডের বিপরীতে মোবাইল নম্বরে আরো একটি হিসাব রাখা শুরু করবো। এতে করে কোনো গ্রাহকের কার্ড সঙ্গে না থাকলেও শুধু মোবাইল নম্বর দিয়ে বুথে লেনদেন করতে পারবেন। টাকাও পাঠাতে পারবেন।”
জাকির হাসান বলেন, “জনবল সংকট আর প্রচারের অভাবে বিপুল এই সেবার কথা সাধারণ মানুষকে জানানো যাচ্ছে না। সেটি সম্ভব হলে বেসরকারি যে কোনো প্রতিষ্ঠানের থেকে বেশি গুরুত্ব পাবে ডাক বিভাগের ক্যাশ কার্ড।”
ডাক বিভাগ জানায়, নির্দিষ্ট আবেদনপত্র পূরণ করে তিন কপি পাসপোর্ট সাইজ ছবি ও ছবিযুক্ত পরিচয়পত্রের অনুলিপি জমা দিলে তাৎক্ষণিকভাবে ক্যাশ কার্ড দেওয়া হয়। এ জন্য ফি বাবদ ৪৫ টাকা জমা দিতে হবে। এর মধ্য থেকে ১০ টাকা আবার গ্রাহকের হিসাবে জমা থাকবে।
একজন গ্রাহক প্রতিবারে ১০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা পর্যন্ত কার্ডের হিসাবে জমা করতে পারবেন। তবে সর্বমোট পাঁচ লাখ টাকার বেশি কখনোই রাখতে পারবেন না।
প্রতিবার একজন গ্রাহক সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত তুলতে পারবেন। প্রতিবার টাকা জমা ও উত্তোলনে পাঁচ টাকা হারে মাশুল দিতে হবে। এ ছাড়া গ্রাহক নিজের কার্ড থেকে অন্য কারো কার্ডেও টাকা স্থানান্তর করতে পারবেন। এ জন্য মাশুল রাখা হবে ১০ টাকা।
Comments[ 0 ]
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন