বাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নজর এড়িয়ে গোঁজামিল দিয়ে আর্থিক প্রতিবেদন তৈরি করেছে মালেক স্পিনিং মিলস লিমিটেড।
কোম্পানিটির মুনাফা ও শেয়ারপ্রতি আয়ের (ইপিএস) হিসাবে করা হচ্ছে অনিয়ম। কয়েকজন পরিচালক পারিশ্রমিক হিসেবে বছরে হাতিয়ে নিচ্ছেন মোটা অংকের টাকা। নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে প্রতিষ্ঠানটির পণ্য উৎপাদন ও বিক্রির ক্ষেত্রে।
বাংলানিউজের অনুসন্ধানে এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি বলছে, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোনো কোম্পানির পরিচালক পারিশ্রমিক হিসেবে বেতন নিতে পারেন না। পরিচালকেরা প্রতিষ্ঠান থেকে শুধু বোর্ড মিটিংয়ে অংশগ্রহণ বাবদ একটি ভাতা গ্রহণ করতে পারেন। প্রতিষ্ঠানটির অনিয়মের বিষয়ে বিএসইসি জানায়, ক্ষতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০১১-১২ অর্থবছরে (জুলাই ২০১১ থেকে জুন ২০১২) প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান এএফএম জুবায়ের মালেক স্পিনিং থেকে পারিশ্রমিক হিসেবে ৩৭ লাখ ৮০ হাজার টাকা তুলে নিয়েছেন। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটির সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান সালেক টেক্সটাইল থেকে তিনি এ সময়ে নিয়েছেন ২৪ লাখ টাকা। অর্থবছরটিতে অনুষ্ঠিত মালেক স্পিনিংয়ের ৭টি বোর্ড মিটিংয়ের মধ্যে এএফএম জুবায়ের অংশ নেন ৫টি বোর্ড মিটিংয়ে।
প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) দায়িত্ব পালন করছেন এ মতিন চৌধুরী। তিনি আইন লঙ্ঘন করে একই সঙ্গে তালিকাভুক্ত অন্য একটি কোম্পানির চেয়ারম্যান ও এমডির দায়িত্ব পালন করছেন। এ মতিন চৌধুরী ২০১১-১২ অর্থবছরে মালেক স্পিনিং থেকে পারিশ্রমিক হিসেবে নিয়েছেন ১৩ লাখ টাকা।
পরিচালক আজিজুর রহিম চৌধুরী একই অর্থবছরে মালেক স্পিনিং থেকে পারিশ্রমিক হিসেবে নিয়েছেন ৮ লাখ ৪০ হাজার টাকা। আর স্বতন্ত্র পরিচালক এম সিকেন্দার আলীকে পারিশ্রমিক হিসেবে দেওয়া হয়েছে ২ লাখ ৬৪ টাকা।
অর্থবছরটিতে অনুষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানটির সবকটি বোর্ড মিটিংয়ে অংশ নেন শামিম মতিন চৌধুরী। আর সাইমা মতিন চৌধুরী সাতটির মধ্যে তিনটি এবং মশিউর রহামান সাতটির মধ্যে ছয়টি বোর্ড মিটিংয়ে অংশ নেন। তবে এই তিন পরিচালক মালেক স্পিনিং থেকে কি পরিমাণ পারিশ্রমিক নিয়েছেন তার কোনো হিসাব দেয়নি প্রতিষ্ঠানটি।
এদিকে প্রতিষ্ঠানটির পণ্য উৎপাদনের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০১০-২০১১ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদন ক্ষমতা ছিল এক কোটি ২৬ লাখ কেজি। ২০১১-১২ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদন ক্ষমতা একই থাকলেও কমে গেছে প্রকৃত উৎপাদন ও বিক্রির পরিমাণ।
২০১১-১২ অর্থবছরে প্রকৃত উৎপাদনের পরিমাণ আগের বছরের তুলনায় ৯ লাখ ৯৬ হাজার ৫১০ কেজি কমে দাঁড়িয়েছে এককোটি দুই লাখ ৮৬ হাজার পাঁচশ’ ৬৫ কেজি। আর বিক্রির পরিমাণ ৫৪ কোটি ২৯ লাখ ৮ হাজর সাতশ’ ৫৫ টাকা কমে দাঁড়িয়েছে ২৯৬ কোটি ৬১ লাখ ৯৭ হাজার টাকা।
প্রতিষ্ঠানটির চলতি অর্থবছরের (২০১২-১৩) সর্বশেষ প্রকাশিত আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, মুনাফা ও ইপিএস’র হিসাবে গোঁজামিল করে প্রকৃত অবস্থার থেকে বেশি দেখানো হয়েছে।
আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের (২০১২ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বর) কর পরবর্তী মুনাফা হয় সাত কোটি দুই লাখ টাকা এবং ইপিএস ৬৪ পয়সা। এরপর অর্ধ বার্ষিকীতে শেষ তিন মাসের অর্থাৎ অক্টোবর-ডিসেম্বর মাসে কর পরবর্তী লোকসান দেখায় ১৬ কোটি ৬৩ লাখ টাকা এবং ইপিএস দেখায় ঋণাত্মক ৮৬ পয়সা। আর অর্ধ বছরের অর্থাৎ প্রথম ৬ মাসে মোট লোকসান দেখায় ৯ কোটি ৬১ লাখ টাকা। আর ইপিএস দেখায় ঋণাত্মক ৫০ পয়সা।
সর্বশেষ প্রকাশিত প্রতিষ্ঠানটি তৃতীয় প্রান্তিকের (২০১৩ সালের জানুয়ারি-মার্চ) আর্থিক প্রতিবেদনে জানুয়ারি থেকে মার্চ এই তিন মাসে কর পরবর্তী ১১ কোটি ৫০ লাখ টাকা মুনাফা দেখিয়েছে। এই ৩ মাসের জন্য ইপিএস দেখানো হয়েছে ৫৯ পয়সা। আর বছরের প্রথম নয় মাসের (জুলাই ২০১২- মার্চ ২০১৩) মোট কর পরবর্তী মুনাফা দেখানো হয়েছে ২৮ কোটি ৭৮ লাখ টাকা এবং ইপিএস দেখানো হয়েছে এক টাকা ৪৯ পয়সা।
নিয়মানুযায়ী এসময় প্রতিষ্ঠানটির মুনাফা হওয়ার কথা এককোটি ৮৮ লাখ টাকা [তৃতীয় প্রান্তিকের (জানুয়ারি-মার্চ) মুনাফা ১১ কোটি ৫০ লাখ টাকা - অর্ধ বছরের (জুলাই-ডিসেম্বর) লোকসান ৯ কোটি ৬১ লাখ টাকা = এককোটি ৮৮ লাখ টাকা)]। আর ইপিএস হওয়ার কথা ৯ পয়সা [তৃতীয় প্রান্তিকের (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ইপিএস ৫৯ পয়সা + অর্ধ বছরের (জুলাই-ডিসেম্বর) ইপিএস (-৫০ পয়সা) = ৯ পয়সা) অথবা তৃতীয় প্রান্তিক শেষে মোট মুনাফা এককোটি ৮৮ লাখ টাকা / মোট শেয়ার সংখ্যা ১৯ কোটি ৩৬ লাখ = ৯ পয়সা ]।
যোগাযোগ করা হলে বিএসইসি’র নির্বাহী পরিচালক সাইফুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, ‘তালিকাভুক্ত একটি কোম্পানির এমডি একই সঙ্গে তালিকাভুক্ত অন্য কোম্পানির এমডি অথবা চেয়ারম্যান থাকতে পারেন না। এবং পরিচালকেরা কোম্পানি থেকে কোনো বেতন নিতে পারবেন না। তবে বোর্ড মিটিংয়ে অংশ নেওয়া বাবদ মিটিং ভাতা পাবেন।’
এসময় বাংলানিউজকের পক্ষ থেকে মালেক স্পিনিংয়ের সার্বিক অবস্থা তুলে ধরলে তিনি বলেন, ‘বিষয়গুলো খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মালেক স্পিনিংয়ের কোম্পানি সচিব সাইফুল ইসলামের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথমে বলেন, ‘আমি মিটিংয়ে আছি আপনি পরে ফোন করেন।’
এরপর আবার টেলিফোন করা হলে তিনি বলেন, ‘কোনো কিছু জানতে হলে আপনি আমাদের অফিসে আসেন। ফোনে কিছু জানানো যাবে না।’
Comments[ 0 ]
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন