তীব্র সংকটেও বাংলাদেশের শিল্প এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন
দামে গ্যাস পাচ্ছে। পাশের দেশ ভারতেই এর দাম আট গুণ বেশি। অথচ এরই মধ্যে রিজার্ভের ৪০ শতাংশের
বেশি গ্যাস উত্তোলন হয়ে গেছে। নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার না হওয়ায় সংকট ক্রমেই তীব্র
হচ্ছে। আমদানির দিকে নজর
দিতে শুরু করেছে সরকার।
এদিকে রফতানি খাতে বিশ্ববাজারের সঙ্গে প্রতিযোগিতার
অজুহাতে সস্তা শ্রমের পাশাপাশি সস্তা জ্বালানি ব্যবহার করে উদ্যোক্তারা সম্পদের
পাহাড় গড়লেও প্রতিনিয়ত চাপে পড়ছে সরকার। গত বছর গ্যাসের দাম এক দফা বাড়ানোর প্রস্তাব উঠলেও শেষ
পর্যন্ত তা স্থগিত হয়ে যায়।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০১৫ সালের পর থেকে গ্যাসের চাপ কমতে শুরু করবে। তাই গ্যাস ব্যবহারে সাশ্রয়ী
হওয়ার পাশাপাশি দাম বাড়ানোর বিষয়টি এখন জরুরি। সরকার আন্তর্জাতিক তেল-গ্যাস
কোম্পানিগুলো থেকে প্রতি ইউনিট (হাজার ঘনফুট) গ্যাস কেনে গড়ে ৩ মার্কিন ডলারে। অথচ শিল্পে তা সরবরাহ হয়
ইউনিটপ্রতি ২ দশমিক ১৯ ডলার দামে। অন্যান্য খাতেও দামের একই অবস্থা।
সম্প্রতি ‘এনার্জি পলিসি অপশন ফর
সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করে
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। এতে এশিয়ার বিভিন্ন দেশের মধ্যে শিল্পে ব্যবহূত গ্যাসের
দামের তুলনামূলক পার্থক্য তুলে ধরা হয়। সিঙ্গাপুরে শিল্পে প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ২ হাজার ৬৬৭
টাকা ১৬ পয়সা। ভারতে তা ১ হাজার ৩৭৭ টাকা ৮৯ পয়সা, থাইল্যান্ডে ৪৬৯ টাকা ৩৮ পয়সা, ইন্দোনেশিয়ায় ৪৫২ টাকা ২৩ পয়সা, মালয়েশিয়ায় ৩৮৭ টাকা ৮৪ পয়সা ও পাকিস্তানে প্রায় ৩৭৭ টাকা ৯৯ পয়সা আর
বাংলাদেশে মাত্র ১৬৫ টাকা ৯৪ পয়সা। সর্বশেষ দাম বাড়ানোর প্রস্তাবে এটি ২২০ টাকা করার কথা
বলেছে পেট্রোবাংলা। এ প্রস্তাব অনুমোদিত হলেও দাম সর্বনিম্ন পর্যায়েই থাকবে।
অন্যান্য জ্বালানির দামের সঙ্গেও তুলনা করা হয়েছে
এডিবির ওই প্রতিবেদনে। প্রতি ইউনিট গ্যাসের সমপরিমাণ শক্তি উৎপাদনে ২৬ দশমিক ২৮
লিটার ফার্নেস অয়েল প্রয়োজন। এ পরিমাণ তেলের দাম ১ হাজার ৫৭৭ টাকা। একই হিসাবে ২৬ দশমিক ৭৭ লিটার
ডিজেলের দাম দাঁড়ায় ১ হাজার ৬৩৩ টাকা।
দাম কম থাকায় শিল্পে ব্যবহারের পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ
গ্যাস অপচয় হচ্ছে বলেও মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। শিল্পে ব্যবহূত বিভিন্ন যন্ত্রাংশের দক্ষতা নিয়েও রয়েছে
নানা প্রশ্ন। দাম বেশি হলে কারখানার উদ্যোক্তারা গ্যাস ব্যবহারে
সচেতন ও দক্ষ হয়ে উঠবেন। কারণ জ্বালানি সাশ্রয়ে পদক্ষেপ না নেয়ায় কারখানায়
ব্যবহূত পুরনো বয়লার ও ক্যাপটিভ বিদ্যুেকন্দ্রে প্রতিদিন সরবরাহকৃত গ্যাসের প্রায় ২৪
শতাংশ অপচয় হয়। আবার শিল্পে বয়লারের চেয়ে ক্যাপটিভ বিদ্যুতে ব্যবহূত
গ্যাসের দাম আরো কম। বর্তমানে ক্যাপটিভে প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ১১৮ টাকা ২৬
পয়সা।
শিল্প-কারখানায় বয়লারের জন্য প্রতিদিন সরবরাহ করা হচ্ছে
মোট উৎপাদনের ১৭ শতাংশ গ্যাস, যার পরিমাণ ৩৭ কোটি ৪০ লাখ ঘনফুট। এর মধ্যে অপচয় হয় ৩ কোটি ৫৬ লাখ
ঘনফুট। আর শিল্পের জন্য
অনুমোদিত ক্যাপটিভ বিদ্যুেকন্দ্রে প্রতিদিন সরবরাহ করা হয় ১৬ শতাংশ, যার পরিমাণ ৩৫ কোটি ২০ লাখ ঘনফুট। এক্ষেত্রে অপচয় হয় ১৩ কোটি ৭০ লাখ
ঘনফুট গ্যাস অর্থাৎ শিল্পে সরবরাহকৃত ৭২ কোটি ৬০ লাখ ঘনফুটের মধ্যে অপচয় হচ্ছে ১৭ কোটি
২৬ লাখ ঘনফুট গ্যাস।
এ প্রসঙ্গে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম. তামিম বণিক বার্তাকে
বলেন, শুধু শিল্পে নয়, সব ক্ষেত্রেই গ্যাসের দাম অনেক
কম। শিল্পে গ্যাস
অপচয়ের অন্যতম প্রধান কারণ স্বল্পমূল্য। তার পরও গ্যাসের দাম যৌক্তিক পর্যায়ে আনা হচ্ছে না। ভোটের রাজনীতির কারণে দলগুলো এ
ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। তবে টিকে থাকতে হলে অবশ্যই দাম বাড়াতে হবে।
সর্বশেষ ২০০৯ সালে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)
সব ধরনের গ্যাসের দাম ১১ দশমিক ২২ শতাংশ বাড়িয়েছিল। এছাড়া ২০১১ সালে দুই দফায়
সিএনজির দাম বাড়িয়ে প্রতি ঘনমিটার ৩০ টাকা করা হয়। গত বছরের ২০ মে সব ধরনের
গ্রাহকের জন্য গ্যাসের দাম বাড়াতে বিইআরসির কাছে প্রস্তাব করে পেট্রোবাংলা। বিতরণ কোম্পানির পক্ষ থেকে
প্রস্তাব জমা দেয়ার আহ্বান জানায় বিইআরসি। ডিসেম্বরে গণশুনানির দিনও ধার্য করা হয়।
নির্ধারিত সময়ে বিতরণ কোম্পানি প্রস্তাব জমা না দেয়ায়
থমকে যায় মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি। এরপর গত এক বছরে এ ব্যাপারে আর কোনো উদ্যোগ নেই।
এ ব্যাপারে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান ড. হোসেন মনসুর
বলেন, সামগ্রিক দিক বিবেচনা করেই নিম্নমূল্যে গ্যাস সরবরাহ
করা হয়। আপাতত দাম বাড়ানোরও কোনো পরিকল্পনা নেই।
প্রসঙ্গত, সারা দেশে আবাসিক গ্রাহক গ্যাস
ব্যবহার করেন মোট উৎপাদনের ১১ শতাংশ। শিল্পে ৩৩ শতাংশ (ক্যাপটিভ বিদ্যুত্সহ), বিদ্যুতে ৪২ শতাংশ, সিএনজিতে ৬ ও সার-কারখানায় ৭ শতাংশ
গ্যাস ব্যবহূত হয়। বাকিটা যায় চা বাগান ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে।
Comments[ 0 ]
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন