রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমেই অশান্ত হয়ে উঠছে। এতে ব্যবসায়ীরা দারুণ শঙ্কিত। নির্বাচনের আগে বিনিয়োগ করে কেউ পুঁজির ঝুঁকি নিতে চাইছেন না। তাই, বিনিয়োগে ভাটা পড়েছে। ব্যাংকগুলোতে অলস টাকার পাহাড় জমছে। উচ্চ সুদের কারণে কেউ ঋণও নিতে চাইছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি সূত্র জানায়, নতুন বিনিয়োগ না হওয়ায় ব্যাংকিং খাতে ৭০ হাজার ছয়শ ৪৪ কোটি টাকা অলস পড়ে আছে। এটি মোট তারল্যের (মোট নগদ মুদ্রা) প্রায় ১২ শতাংশ বেশি।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ নেই। তাই, তারা হাত গুটিয়ে বসে আছেন। নগদ টাকা যাদের কাছে আছে, তারা তা ব্যাংকে রেখে দিয়েছেন। তাই, ব্যাংকগুলোতে তারল্য (নগদ মুদ্রা) বাড়ছে।
সূত্র জানায়, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ব্যাংকিং খাতে অলস টাকা ছিল ৬০ হাজার কোটি। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে ছিল ৫৮ হাজার কোটি। ডিসেম্বরের পর থেকে প্রতিমাসেই ব্যাংকগুলোয় তারল্য বাড়ছে।
তারল্য বাড়ার পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ব্যাংকে অব্যবহৃত টাকা ছিল ৬১ কোটি ৭০ লাখ, মার্চে ৬৬ কোটি, এপ্রিলে ৬৯ কোটি, মে মাসে ৬৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা। সবশেষ জুনে তারল্য দাঁড়িযেছে ৭০ কোটি ছয়শ ৪৪ লাখ টাকায়।
সূত্র জানায়, প্রত্যেক তফসিলি ব্যাংকেই সব মিলিয়ে তার তলবি ও মেয়াদী দায়ের ১৯ শতাংশ তারল্য জমা রাখতে হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে। কিন্তু, অতিরিক্ত তারল্য থাকার কারণে ব্যাংকগুলো তারল্য রেখেছে প্রায় ৩১ শতাংশ।
জানা যায়, মহাজোট সরকারের সাড়ে চার বছরের বেশির ভাগ সময়ই তারল্য সংকটে ভুগেছে ব্যাংকগুলো।
এবারই প্রথম উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছে। ২০০৯ থেকে ২০১২ সালের পুরো সময়জুড়েই ছিল ঋণ সংকট। ব্যবসায়ীদের ঋণ দেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত তহবিল ছিল না ব্যাংকে। ব্যাংকে টাকার জন্য ঘুরে হতাশ হতে হয়েছে অনেক ব্যবসায়ীকেই।
বিনিয়োগ না হওয়ার কারণ সম্পর্কে এফবিসিসিআই-এর সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু বাংলানিউজকে বলেন, “অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশে ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ করবে কীভাবে! যেখানে প্রকাশ্যে চাঁদবাজি করছে ছাত্র সংগঠনগুলো! আমরা মনে করি না, বিনিয়োগের কোনো পরিবেশ বর্তমানে আছে। তাই, অলস টাকার পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে।”
এফবিসিসিআই-এর সহ-সভাপতি হেলাল উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, “এটি নির্বাচনী বছর।
অপরদিকে, ব্যাংকের উচ্চ সুদের হার। কীভাবে বিনিয়োগ করবো আমরা? এই অবস্থায় সম্ভব না। বিনিয়োগ করতে গেলে সে সম্পদ দেখিয়ে বিনিয়োগ করতে হয়, তা শেষ হয়ে যাবে। এটি কোনো ব্যবসায়ীই চায় না।
এক ব্যবসায়ীর উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, “একজন ব্যবসায়ীর কাছে আমি জানতে চাইলাম বিনিয়োগ করছেন না কেন? তিনি বললেন- বিনিয়োগ করছি না মানে! করছি তো। ব্যাংকে টাকা রেখে দিয়েছি। এটাই তো বিনিয়োগ।”
হেলাল উদ্দিন আরো বলেন, “বিত্তবানদের হাতে ব্যাংকগুলো জিম্মি হয়ে পড়েছে। ব্যাংকিং খাত লুটেরাদের হাতে চলে গেছে। বিভিন্ন সময় ক্ষমতাসীনরা এ সব ব্যাংকের অনুমোদন করিয়ে নিয়েছে। তারা একটি সিন্ডিকেট। তাদের সঙ্গে পারা সম্ভব নয়।”
হেলাল উদ্দিন জানান, ব্যাংকের সুদের হার ২০ থেকে ২২ শতাংশ। এ সুদে কেউ বিনিয়োগ যাবে। নির্বাচনী বছরে অনিশ্চয়তার কারণেও অনেকে বিনিয়োগে অনীহা দেখাচ্ছেন।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই’র সাবেক সভাপতি একে আজাদ তার মেয়াদের পুরো সময় প্রকাশ্যে ঋণ সংকটের কথা বলেছেন। এনিয়ে তিনি দেন-দরবারও করেছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে। কিন্তু, ২০১৩ সালের চিত্রটি পুরোপুরি উল্টো। ঋণ দেওয়ার জন্য ব্যবসায়ীদের পেছনে ঘুরছে ব্যাংকগুলো। কিন্তু, বড় অঙ্কের ঋণ নেওয়ার ব্যবসায়ী খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে, ব্যাংকিং খাতে জমেছে বিপুল অঙ্কের বাড়তি তারল্য।
জানা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে অনেকটা সংযত মুদ্রানীতি দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যক্তিখাতে ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ১৮ শতাংশের কিছু বেশি। কিন্তু, সবশেষ হিসাব মতে, তা ১৩ শতাংশের কাছাকাছি অবস্থান করছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, রাজনৈতিক এই পরিস্থিতিতে কেউ তারা ঝুঁকি নিয়ে আর কোনো বড় বিনিয়োগে এ মুহূর্তে যেতে চাইছেন না। নির্বাচনের বছরে সহিংসতা থাকবে। নতুন নির্বাচিত সরকার গঠন হলেই তারা বিনিয়োগে যাবেন।
এদিকে, ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, উচ্চ সুদ, অবকাঠামো সংকট, রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ নানা কারণে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার আগ্রহ হারিয়েছেন বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা। এ কারণে দেশের ব্যাংকগুলোয় পড়ে থাকা অলস টাকার পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে।
ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগে আগ্রহ হারানোর প্রমাণ মেলে মূলধনী যন্ত্রপাতি ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানি চিত্র দেখেও।
চলতি ২০১২-১৩ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ঋণপত্র নিষ্পত্তিভিত্তিক মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে ১৮ দশমিক ০৯ শতাংশ। শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমেছে ৫ দশমিক ১১ শতাংশ। মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি কমেছে ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ। বিবিধ শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে ৯ দশমিক ৫৮ শতাংশ।
Comments[ 0 ]
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন