দেশের প্রধান
রপ্তানি পণ্য তৈরী পোশাক যুক্তরাষ্ট্রের ‘জেনারেলাইজড
সিস্টেম অব প্রিফারেন্স’ (জিএসপি) সুবিধা পায় না। তাই জিএসপি সুবিধা স্থগিত হলেও বস্ত্র খাতে এর
নেতিবাচক প্রভাব পড়ার কোনো কারণ নেই। যুক্তরাষ্ট্র
বাংলাদেশকে কিছু অপ্রচলিত রপ্তানি পণ্য যেমন, কাঁচা
চামড়া, ফার্নিচার, সিরামিক্স,
সার,
কার্পেট,
গলফ
খেলার সামগ্রী, হিমায়িত খাদ্য এবং বিশেষভাবে বোনা
শক্ত ফেব্রিকে (ত্রিপল, তাবু ইত্যাদি) জিএসপি সুবিধা দেয়। জিএসপি সুবিধা প্রদানের বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র
বাংলাদেশ থেকে বিশেষ কিছু সুবিধা চায় বলে দীর্ঘদিন থেকে এ নিয়ে নানা নাটক মঞ্চায়ন
চলছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
অন্যদিকে, জিএসপিকে কেন্দ্র করে শেয়ারবাজারে
বস্ত্র খাতের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে কিছু দিন ধরে প্যানিক সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে
একটি গোষ্ঠী। এরা বাজারে
বস্ত্রখাতের কোম্পানিগুলোর শেয়ার দর ফেলে দিয়ে কম দরে শেয়ার হাতিয়ে নেয়ার
চক্রান্তে লিপ্ত রয়েছে বলে বাজার বিশ্লেষকরা মনে করছেন। জিএসপি-কে কেন্দ্র করে বস্ত্রখাতের বিনিয়োগকারীরা
কিছু দিন যাবত সংশয়ের মধ্যে রয়েছেন, যার
কোনো ভিত্তি নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, জিএসপি
সুবিধার আওতায় বাংলাদেশ পাঁচ হাজার ধরণের পণ্য যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শুল্কমুক্ত
সুবিধার আওতায় রপ্তানি করে। এর
মধ্যে পোশাক খাতের পণ্য নেই। সুতরাং
জিএসপি সুবিধা বাতিলের কারণে বস্ত্র খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে এমন ধারণা যারা
পোষণ করেন তারা ফায়দা হাসিলের জন্যই বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন বলে বিশ্লেষকরা দৃঢ়তার
সাথে দাবি করেন।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর হিসাব মতে, ২০১১-১২
অর্থবছরের বাংলাদেশ মোট রপ্তানি করেছে ২ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের পণ্য। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করেছে মোট রপ্তানির
২১ শতাংশ। অর্থাৎ প্রায় ৫০০
কোটি ডলার। এর মাত্র এক
শতাংশ জিএসপি সুবিধার আওতায় রপ্তানি করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে জিএসপি সুবিধা বাতিলের কারণে
বাংলাদেশের কী পরিমাণ ক্ষতি হতে পারে তার কষতে শুরু করেছেন অর্থনীতিবীদরা। তবে জিএসপি সুবিধা স্থগিতের কারণে আর্থিক ক্ষতি যাই
হোক না কেন, বর্হিবিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তির যে
অনেক ক্ষতি হয়েছে এতে কোনো সন্দেহ নেই।
পোষাক খাতে কর্ম পরিবেশ অবনতির কারণ দেখিয়ে যুক্তরাষ্ট্র্র জিএসপি সুবিধা
স্থগিত করেছে। শ্রমিকদের
কাজের পরিবেশ উন্নতি হলে এ স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করা হবে বলে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ
থেকে জানানো হয়েছে। অর্থাৎ কাজের
পরিবেশ উন্নতি হলে এ সুবিধা আবারো চালু হবে।
ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা গতকাল এক অনুষ্ঠানে বলেছেন,
বাংলাদেশের
জিএসপি সুবিধা বাতিল করা হয়নি, স্থগিত করা
হয়েছে। সাংবাদিকদের
তিনি জানান, বিয়োগান্তক ঘটনা যাতে আর না ঘটে,
সে
জন্য জিএসপি সুবিধা স্থগিত করা হয়েছে। এখন
বাংলাদেশের উচিত শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ উন্নত করা। এতে বাংলাদেশেই লাভবান হবে।
এদিকে, সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে,
বাংলাদেশের
রফতানিকৃত তৈরি পোশাক শিল্পের পণ্যের ক্ষেত্রে গড় আন্তর্জাতিক শুল্ক যেখানে ১২ শতাংশ,
যুক্তরাষ্ট্রের
বাজারের ক্ষেত্রে তা ১৫ শতাংশ। এছাড়া
৯৭ শতাংশ পণ্যের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে জিএসপি সুবিধা দিলেও মাত্র ২২ মিলিয়ন
ডলারের বিশেষ কোটা বাদে পোশাক শিল্পের পণ্যকে এই সুবিধার আওতার বাইরে রাখা হয়েছে।
জিএসপি সুবিধা বাতিলের ব্যাপারে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সভাপতি
আহসানুল ইসলাম টিটো বলেন, এ কারণে টেক্সটাইল খাতে নেতিবাচক
প্রভাব পড়বে না। তিনি জানান,
জিএসপি
সুবিধার আওতায় বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে খুব বেশি সুবিধা পায় না। ফলে আর্থিক প্রভাব খুব বেশি পড়ার আশংকা নেই। তবে ভাবমূর্তির ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
ডিএসই সভাপতি আরো বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে
জিএসপি স্থগিত হওয়ায় বাংলাদেশের বেশ কিছু পণ্য দেশটিতে শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা
হারাবে। তবে বাংলাদেশের
প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক (আরএমজি) যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রাধিকারমূলক এ বাজার
সুবিধা পায় না বলে রপ্তানির ক্ষেত্রে বস্ত্রখাতের পণ্যের কোনো সমস্যা বা ক্ষতি হবে
না।
এদিকে, বস্ত্র খাত সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোও
জিএসপি সুবিধা বাতিলে তেমন নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না বলে মনে করছে। তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো
জিএসপি সুবিধার স্থগিতাদেশ তুলে নেয়ার ক্ষেত্রে বেশ আশাবাদী। তারা বলছেন, এ
স্থগিতাদেশ একেবারেই সাময়িক। এটি
এক ধরণের চাপ প্রয়োগের রাজনৈতিক কৌশল।
তাদের মতে, পোশাক কারখানায় বেশ কয়েকটি দুর্ঘটনায়
শত শত শ্রমিকের মৃত্যুর পর
কারখানার কর্ম পরিবেশ উন্নত করা, শ্রমিকদের বেতন
বাড়ানোসহ নানা উদ্যোগ ইতিমধ্যে গ্রহণ করেছে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান। পাশাপাশি শ্রমিকদের কর্ম পরিবেশ উন্নত করার লক্ষ্যে
শ্রমিক আইন প্রনয়নও চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। আশা
করা যাচ্ছে, পোশাক খাতসহ অন্যান্য খাতে ধীরে ধীরে
শ্রমিকদের সহায়ক কর্ম পরিবেশ প্রতিষ্ঠিত হবে এবং এক্ষেত্রে কাক্সিক্ষত উন্নতি
সাধিত হবে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারারস অ্যান্ড এক্সপোর্টাস
এসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সভাপতি মো. আতিকুল ইসলাম শেয়ারনিউজ২৪ডটকমকে বলেন,
যেহেতু
দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব পড়বে না,
তাই
বস্ত্র খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা নেই। তিনি আরো বলেন, শ্রমিক
আইন না থাকার কারণেই মূলত: এ সুবিধা বাতিল করা হয়েছে। এটি প্রণীত হলে কর্ম পরিবেশ উন্নত হবে এবং বিশ্বে
আমাদের ভাবমূর্তিও উজ্জ্বল হবে।
বিজিএমইএ’র দ্বিতীয় সহ-সভাপতি এসএম মান্নান কচি
বলেন, জিএসপি সুবিধা স্থগিতের ফলে আপাতত: অর্থনৈতিকভাবে
বাংলাদেশের তেমন ক্ষতি হবে না। যেহেতু
পোশাক খাত আগে থেকেই এ সুবিধা পাচ্ছে না, সুতরাং
এ খাতে প্রভাব পড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। একই
প্রসঙ্গে সংগঠনটির সাবেক সভাপতি সফিউল আজম বলেন, বস্ত্র
খাতেই জিএসপি সুবিধা নেই। তাই এ
স্থগিতাদেশের কোনো প্রভাব বস্ত্র খাতে পড়বে না।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন,
জিএসপি
স্থগিতের কারণে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্থ হবে। তবে
রপ্তানি খাতে বড় কোনো প্রভাব পড়বে না। তবে
এ সুবিধা স্থগিতের পেছনে মার্কিন সরকারের টিকফা চুক্তি সইয়ের চাপ থাকতে পারে বলেও
মনে করেন তিনি।
জানা যায়, গত অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্রের
প্রভাবশালী সংগঠন ‘আমেরিকান অর্গানাইজেশন অব লেবার-কংগ্রেস
ফর ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন (এএফএল-সিআইও) বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা বাতিলের
আবেদন করে। এর ঠিক পরের
মাসেই আশুলিয়ার তাজরিন ফ্যাশনসে আগুন লেগে ১১২ শ্রমিকের মৃত্যু হয়।
এরপর যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর আহ্বানে সাড়া দিয়ে প্রেসিডেন্ট বারাক
ওবামা গত জানুয়ারিতে জিএসপি সুবিধার বিষয়টি পর্যালোচনার উদ্যোগ নেন। যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট কমিটিতে এ বিষয়ে শুনানির
মধ্যেই গত ২৪ এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজা ধসে ১ হাজার ১২৭ জন পোষাক শ্রমিকের
মৃত্যু হয়। এ ঘটনার পর
নতুন করে সংশয়ের মুখে পড়ে বাংলাদেশের জিএসপি-ভাগ্য।
প্রসঙ্গত, উন্নয়নশীল দেশগুলোকে অগ্রাধিকারমূলক
বাণিজ্য-সুবিধা দিতে যুক্তরাষ্ট্রের ’৭৪-এর
বাণিজ্য আইন অনুযায়ী জিএসপি চালু হয়। ১৯৭৬
সালের ১ জানুয়ারি থেকে এটি কার্যকর হয়। জিএসপির
আওতায় যুক্তরাষ্ট্রে পাঁচ হাজার পণ্য রপ্তানির সুযোগ পায় উন্নয়নশীল দেশগুলো। আর বাংলাদেশ এ সুবিধার আওতায় মূলত: সিরামিক পণ্য,
চশমা,
তাঁবু,
প্লাস্টিক
ব্যাগ, উলের তৈরি পোষাক ও শতরঞ্জি যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি
করে থাকে।
২০১২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যেও মোট পরিমাণ
ছিল প্রায় ৫৪০ কোটি ডলার। এর মধ্যে
বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করেছে ৪৯০ কোটি ডলার। আর যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করেছে ৫০ কোটি ডলারের
পণ্য। এর মধ্যে মাত্র ২২ কোটি ডলার জিএসপি
সুবিধার আওতায় বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করা হয়।